Thursday, October 31, 2019

৩০ বছর বয়সের মধ্যে লাইফ ইনস্যুরেন্স করার ৭টি সুবিধা


বীমা বার্তা ডেস্ক: জীবন বীমা এমন একটি চুক্তি যেখানে এককালীন অর্থ বা নির্দিষ্ট সময়ান্তে কিস্তি পরিশোধের বিপরীতে বীমাগ্রহীতার মৃত্যুতে অথবা নির্ধারিত বছরসমূহ শেষে বীমা কোম্পানি বৃত্তি অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জীবন বীমা সাধারনত নিজের আর্থিক সুবিধার জন্য নয়। বরং বীমা গ্রহীতার অবর্তমানে তার ওপর নির্ভরশীলদের জন্য আর্থিক সমর্থন যোগানোই জীবন বীমার মূল লক্ষ্য। তাই মানুষের আর্থিক জীবনযাত্রায় জীবন বীমা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক সংযোজন। জীবন বীমার অনেকগুলো সুবিধা রয়েছে যা আপনার এবং আপনার পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। আপনার পরিবারের ভবিষ্যৎ আপনার নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারনে জীবন বীমা এক পথ প্রদর্শকের ভুমিকা পালন করে। একজন ব্যক্তি ৩০ বছর বয়সের মাঝে জীবন বীমা করার মধ্যে নিজের ভবিষ্যৎকে অনেক জায়গায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

৩০ বছর বয়সের মাঝে জীবন বীমা করার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা সম্পর্কে জেনে নিতেই এই লেখাটি-

১। দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় –

একজন যুবকের ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে গুছিয়ে তোলার যে পরিকল্পনা দরকার তা হতে হয় দীর্ঘ মেয়াদী। ৩০ বছর বয়সের মাঝে করা জীবন বীমা আপনাকে অর্থ সংরক্ষণ ও ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় গড়ে তুলতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঞ্চয় উপাদানের জন্য এই বয়সটি একটি আদর্শ সময়, যা আপনার অবসর পরবর্তী জীবনের আর্থিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে। এমনকি তা আপনার সন্তানের ভবিষ্যত লক্ষ্য পূরণের কাজেও আসবে। এভাবে ভবিষ্যত গড়তে জীবন বীমায় সুরক্ষা ও সঞ্চয় উভয় সুবিধাই ভোগ করা যায়। তাই ৩০ বছর বয়সের মাঝে গড়ে তোলা পরিকল্পনার প্রথম নির্দেশনের মাঝে অন্যতম হলো জীবন বীমা করা।

২। বিনিয়োগে রিটার্ন –

৩০ বছর বয়সের মধ্যে জীবন বীমা হতে পারে একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত কারন জীবন বীমা আপনাকে যুবক বয়স থেকেই দীর্ঘমেয়াদী নিশ্চিত নিরাপত্তা প্রদান করে। জীবন বীমায় বীমাকৃত ব্যক্তি মেয়াদী বোনাসের সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা পলিসির নগদ মূল্যের সাথে জমা হয়। বিনিয়োগকৃত অর্থ পলিসির মেয়াদ শেষে অথবা বীমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পর নিশ্চিত অর্থ (যে পরিমাণ অর্থের জীবন বীমা করা হয়) হিসেবে রিটার্ন আসবে। যা আপনি না থাকলেও আপনার পরিবারের জন্য এক অদৃশ্য অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবে এবং আপনার অবর্তমানে আপনার পরিবারের নিরাপত্তা আপনি নিশ্চিত করতে পারেন। এছাড়া, এই বয়সে বীমা করা মানে মৃত্যুর ঝুঁকিতে কম থাকা। ফলে আপনি নিজেই নির্দিষ্ট সময় শেষে আপনার কাঙ্ক্ষিত ম্যাচিউরিটি ভ্যালু (বীমা অঙ্ক + বোনাস) পেতে পারবেন।


৩। লোন গ্রহণের সুযোগ-

নিজেকে গড়তে ও নিজের প্রয়োজনের জন্য লোন গ্রহন, একজন ব্যক্তিকে এগিয়ে যেতে অনেক বেশী সহায়তা করে। চরম আর্থিক প্রয়োজনে বীমাকারী প্রতিষ্ঠান আপনাকে লোন গ্রহণের সুবিধা প্রদান করে। লোনের পরিমাণ মূলত পলিসির নিয়ম বা আইনের উপর নির্ভর করে। নিজেকে সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ৩০ বছরের মাঝে লোন গ্রহন একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। আর জীবন বীমায় এই লোন নেবার সুযোগ থাকে সবচেয়ে বেশী। নিজেকে ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তা হিসেবে দাঁড় করাতে জীবন বীমা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।

৪। কর সুবিধা

জীবন বীমায় আপনি চমৎকার কর সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। বীমার আয় কিংবা পলিসি লোনের ক্ষেত্রে কোন কর প্রদান করতে হয় না। তাছাড়া বীমার পলিসি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত কর আরোপের সম্ভাবনা থাকে না। ৩০ বছর বয়সের মাঝে জীবন বীমা করলে, আপনি আপনার চাকরির পুরো সময়টা জুড়েই এই কর সুবিধা (বীমা পলিসির মেয়াদ পর্যন্ত) উপভোগ করে যেতে পারবেন। আর এই পলিসির বিপরীতে আপনি যদি কোন লোন নিয়ে থাকেন অথবা নিতে চান, সেই লোনেও কোন কর প্রদান করা লাগবে না।

৫। সমন্বয়যোগ্যতা বিবেচনা

অনেক সময় বীমাকৃত ব্যক্তি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে তাদের বীমা পলিসিগুলো হতে প্রাপ্য সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল অথবা প্রয়োজন অনুযায়ী বীমা অঙ্ক উপযুক্ত হচ্ছে না। সেক্ষত্রে কিন্তু সহজেই প্রয়োজন ও সুবিধার মধ্যে সমন্বয় করা যায়। বীমাগ্রাহক স্বাধীনভাবে বীমার উত্তরাধিকারী নির্বাচন করতে পারেন, যারা পরবর্তীতে মৃত্যুকালীন সুবিধা ভোগ করবেন। ৩০ বছর বয়সের মাঝে জীবন বীমা করলে আপনি নিজের মত করে উত্তরাধিকার গড়ে তুলতে পারবেন আর তাকেও এই পলিসি সম্পর্কে ভাল একটি ধারনা দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে আপনার সুবিধামত সময়ের মধ্যে পলিসি সমন্বয় করে নিতে পারেন। এছাড়া এই বয়সে বেশ অল্প মূল্যেই আপনি বীমা পলিসি গ্রহণ করতে পারবেন। কারন বয়স যত কম হবে বীমা প্রিমিয়ামের মাত্রাও সেই অনুপাতে বেশ কম হবে।

৬। জীবনের ঝুঁকির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা-

বিপদ অথবা সমস্যা কখনো সময় বুঝে শুনে বা সংকেত দিয়ে আসে না। বীমাগ্রহীতার আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় তার পরিবারের উপর নেমে আসতে পারে চরম আর্থিক দুর্ভোগ, যা মোকাবেলায় জীবন বীমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ৩০ বছর বয়সের মধ্যে জীবন বীমা করার মাধ্যমে আপনার ও পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিত হয়। আপনার অবর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে জীবন বীমা আপনার পরিবারের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন নিশ্চিত করবে।

৭। বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা –

৩০ বছর বয়সের মাঝে একজন মানুষ তার জীবনকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন। তাই জীবন বীমার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আপনি জীবনের নানা লক্ষ্য পূরণের পরিকল্পনা করতে পারেন। জীবনের একেকটি পর্যায়ে আপনি ও আপনার পরিবার বিভিন্ন প্রয়োজনের সম্মুখীন হতে পারেন। এছাড়া অনেক বড় বাঁধা বিপত্তি আপনাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নাও দিতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে আপনাকে জীবন বীমা দরকারি প্রয়োজন পূরণে সহায়তা করবে। আপনার সন্তানের শিক্ষার ব্যায় বহন করা, আপনার নিজের একটা স্বপ্নের পরিকল্পনা, বাড়ি বানানো, নিজের একটি ব্যাবসায় গড়ে তোলা কিংবা অবসরের পরবর্তী দিনগুলো সুন্দরভাবে কাটানো – সবকিছু কিন্তু জীবন বীমার মাধ্যমে সম্ভব! এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন ব্যবসা বাণিজ্যের পরিকল্পনার সহযোগি হিসেবে জীবন বীমা অনেক বেশী প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক দুর্বলতা ও নানা ঝুঁকির পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। এতে করে বীমার খরচও বেড়ে যায়। অর্থাৎ তরুণ বয়সে যত অল্প খরচে বীমা করা যাবে বয়সকালে তা সম্ভব হবে না। অল্প বয়সে বীমা করলে মাসিক/বাৎসরিক প্রিমিয়ামের পরিমাণ কম থাকে যা বীমার পুরো মেয়াদকাল পর্যন্ত স্থির থাকে। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও আপনি সেই প্রথম বছরের সেট করা প্রিমিয়াম দিয়েই বীমাটি চালিয়ে যেতে পারবেন। তাই অল্প সময়ের জন্য বারবার বীমা করার চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী একটি বীমা করা ভালো।

যদি আপনার বয়স ৩০ বছরের মাঝে হয়ে থাকে কিন্তু এখনো বীমা করেননি, তাহলে আপনি বিভিন্ন বীমা কোম্পানির পলিসিগুলি বিশ্লেষণ করে একটি কাঙ্ক্ষিত জীবন বীমা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন যা আপনার পরিবারকে অসাধারণ সব সুবিধা প্রদান করবে এবং আপনার অবসরের সময়কালটা স্বাচ্ছন্দে কাটাতে সহায়তা করবে।

সূত্র: গার্ডিয়ান লাইফ

স্বল্প প্রিমিয়ামে ঝুঁকি মোকাবেলার নতুন বীমা পণ্য আনলো ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিঃ


বীমা বার্তা: যারা সঞ্চয় করতে সক্ষম নয় কিংবা যারা সঞ্চয় করতে আগ্রহী নন অথচ ঝুঁকি মোকাবেলার সুবিধা বহন করতে ইচ্ছুক, তাদের জন্য স্বল্প প্রিমিয়ামের নতুন বীমা পণ্য বাজারজাত করার জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (IDRA)’র অনুমোদন পেয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় এবং সূদমুক্ত ও শরীয়া ভিত্তিক জীবন বীমা কোম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিঃ।সম্প্রতি কোম্পানির এ্যাকচ্যুয়ারীয়াল ডিপার্টমেন্টের জারি করা এক সার্কুলার থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

নতুন বীমা পরিকল্প নং ১৮ মেয়াদী বীমা পরিকল্প (মুনাফাবিহীন) বিপণন প্রসঙ্গে জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী ২০ থেকে ২৮ বছর বয়সে নূন্যতম ৫ বছর মেয়াদে প্রতি হাজার টাকার বীমা অংকেংর জন্য প্রিমিয়াম দিতে হবে মাত্র ১ টাকা ৯১ পয়সা থেকে ১ টাকা ৯৮ পয়সা; ২৯ থেকে ৩৭ বছর বয়সে ২ টাকা ১ পয়সা থেকে ২ টাকা ৮২ পয়সা; ৩৮ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ৩ টাকা ৭ পয়সা থেকে ৩ টাকা ৭২ পয়সা; ৪১ থেকে ৪৪ বছর বয়সে ৪ টাকা ১৩ পয়সা থেকে ৫ টাকা ৮০ পয়সা; ৪৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সে ৬ টাকা ৫১ থেকে ১০ টাকা ২২ পয়সা এবং ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ১১ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ৩১ টাকা ৩৫ পয়সা হারে প্রিমিয়াম দিতে হবে।

১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত এই বীমা করা যাবে এবং বীমাটির মেয়াদ ৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

বীমা অংক সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩৫ লক্ষ টাকা।

স্বল্প প্রিমিয়ামের এই বীমার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে শুধু ঝুঁকি মোকাবেলার সুবিধা পাওয়া যাবে, মেয়াদ শেষে ঝুঁকি সুবিধাও শেষ হয়ে যাবে এবং কোন অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে না।অর্থাৎ, এই বীমার জন্য আপনি যে প্রিমিয়াম দিবেন সেটা হলো বীমাবৃত হওয়ার সার্ভিস এবং এর মাধ্যমে আপনি কোন আর্থিক সুবিধা পাবেন না; কিন্তু বীমাবৃত অবস্থায় আপনি মারা গেলে আপনার পরিবার বা যাকে আপনি উইল করে যাবেন তিনি বা তারা এই সুবিধা পাবেন।

সত্যিকথা বলতে কি, যারা শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে তারা ফারইস্টের এই নতুন বীমায় মোটেও উৎসাহী হবে না।কিন্তু যেসব দায়িত্ববান বাবা নিজের স্ত্রী-সন্তান বা পরিবারের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবেন তারা এই বীমার সুবিধা নিতে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হবেন বলে আশা করা যায়।#

Wednesday, October 16, 2019

বীমা খাতে আস্থার সংকট: দায়ী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরী

মুহাম্মদ আবুল হুসাইন:


পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জীবন বীমাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়।বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে বীমা শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটলেও আমাদের দেশে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পারিপার্শ্বিকতার বিচারে বীমা শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও আশানুরূপ উন্নতি লাভ করতে পারেনি।এর মূল কারণ বীমা শিল্প-সম্পর্কে বদ্ধমূল নেতিবাচক ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং আস্থার সংকট।

বীমা হলো গ্রাহক ও বীমা কোম্পানির মধ্যকার ‘‘বীমা চুক্তি’’ যা 'বীমাকারীর কাছ থেকে বীমাদাতাকে আর্থিক ঝুঁকি হস্তান্তরের নীতিতে কাজ করে। বীমাকৃত হিসেবে, আপনি অপ্রত্যাশিত ঘটনার ক্ষেত্রে, বীমাকারীর (কোম্পানির) কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য প্রিমিয়াম প্রদান করেন। সুতরাং, বীমা থাকা আপনার কাঁধের উপর আর্থিক বোঝা হ্রাস করে।

আরো সহজভাবে বললে বলা যায়, বীমা হল অর্থের বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ন্যায়সঙ্গত ও নির্দিষ্ট ঝুঁকির স্থানান্তর। এর মাধ্যমে বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের (প্রিমিয়ামের) বিনিময়ে গ্রাহকের আংশিক বা সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। এটি অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি অংশ।

বীমা কোম্পানিগুলোকে প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে বীমাকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে মুক্ত থাকে এবং অসংখ্য বীমাকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে বীমা কোম্পানিগুলো মূলধন বৃদ্ধি করে।বীমা প্রক্রিয়া, ক্ষয়ক্ষতির ধরন এবং ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু মূলনীতি মেনে চলতে হয়।

ভারতসহ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে সার্বিক আর্থিক খাত বিশেষ করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বাড়াতে বীমা খাত তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।উন্নত বিশ্বে তো বীমা খাত বিরাট ভূমিকা পালন করছে।তবে তাদের তুলনায় আমাদের বীমা খাত এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।বৈশ্বিক না হোক, আঞ্চলিক পর্যায়ে উন্নীত করতে হলেও বাংলাদেশের বীমা শিল্পে আমাদের অনেক সংস্কার করতে হবে।

কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু বীমা কোম্পানির অনিয়ম, দুর্নীতি আর পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা পরিশোধ না করায় দেশের বীমা শিল্পে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো বীমা শিল্পকে।কারণ আস্থা সংকটের কারণে গ্রাহকরা বীমা করতে চাচ্ছে না।ফলে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।

সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)'র জারি করা অফিস আদেশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বীমা শিল্পের বিকাশের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি বীমা প্রতিষ্ঠানের দাবি পরিশোধের হার অত্যন্ত কম হওয়ায় এ খাতে আস্থার সংকট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বীমা গ্রহীতা অধিক সংখ্যায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করছেন এবং মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের অবহিত করছেন। এ অভিযোগসমূহ নিষ্পত্তিতে বীমাকারী দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিচ্ছে এবং জবাবদিহির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না, এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা বেশি নয়।তবে কয়েকটি কোম্পানি এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।এ খাতের আস্থা অর্জনের জন্য সবার আগে গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে হবে।

আইডিআরএর সদস্য গোকুল চাঁদ দাস বলেন, মোট জীবন বীমার প্রায় ৮০ ভাগ দাবি সময়মতো নিষ্পত্তি হয়।কিন্তু কিছু কোম্পানি রয়েছে তাদের পলিসির বড় অংশ অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।যে কারণে পুরো খাতে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। আইডিআরএ চাচ্ছে এসব কোম্পানির দাবিগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন করতে।

কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিষ্পন্ন দাবি প্রাথমিকভাবে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পর্যায়ের কয়েকজন নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্বও দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, আইডিআরএ’র কাছে কয়েক হাজার অভিযোগ জমা পেড়েছে। জমানো টাকা ফিরে পেতে প্রতিদিনই গ্রাহকরা আইডিআরএ অফিসে ভিড় করছেন। পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও বছরের পর বছর বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করছে না।

সর্বশেষ হিসাবে বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ৫৭২ কোটি টাকা। জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক দক্ষতা নিয়ে আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসব পলিসির বিপরীতে সুদসহ হিসাব করলে তা কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। 

আইডিআরএর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মেটলাইফের অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা।প্রগেসিভ লাইফের ৪০ কোটি ৯৪ লাখ ও পদ্মা ইসলামী লাইফের ২৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকার দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে।  সানলাইফের ১৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকার বীমা দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে। এছাড়া গোল্ডেন লাইফের ৬৭ কোটি, বায়রা লাইফের ১৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার, ন্যাশনাল লাইফের ৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকার বীমা দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা কোম্পানি জীবন বীমা কর্পোরেশনের অনিষ্পন্ন দাবির পরিমাণ ১৮৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। মেঘনা লাইফের ১৭ কোটি ৯৩ লাখ, সন্ধানী লাইফের ১৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বীমা দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে।

বিদেশি মালিকানার বীমা কোম্পানি মেটলাইফের অধীনেই দেশের জীবন বীমার ২৩ শতাংশ হয়েছে।প্রগেসিভ লাইফ ও পদ্মা ইসলামী লাইফ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত, সর্বশেষ বছরে এই দুই কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ডিভিডেন্ডও দেয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির মালিকরা অনেক প্রভাবশালী। ফলে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া যাচ্ছে না।কিন্তু অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে সামগ্রীকভাবে বীমা খাতে যে অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছে ভাল কোম্পানিগুলোও।পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, বীমার নাম শুনলেই সাধারণ মানুষ বিরূপ মন্তব্য করে থাকে।এই নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে এই খাতে যোগ্য বীমাকর্মীরও সংকট দেখা দিয়েছে।কারণ, সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা সংকট বিদ্যমান থাকায় বীমা কর্মীর বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।ফলে সহজে কেউ বীমা কর্মী হতে চান না।

এ প্রসঙ্গে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চিফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) বিনীত আগরওয়াল বলেন, জীবন বীমার গ্রাহকরা সঠিকভাবে দাবির টাকা না পাওয়ায় এই খাতে একধরনের ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে প্রয়োজনীয় এজেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন এজেন্ট না আসায় নতুন ব্যবসাও আসছে না। ইমেজ সঙ্কট কাটানো গেলে অবশ্যই বীমা খাতের আওতা বাড়বে। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে বীমা কোম্পানিগুলো বছরে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে তার ৭৩.৫ শতাংশই জীবন বীমা কোম্পানির। বাকি ২৬.৫ শতাংশ সাধারণ বীমা কোম্পানির। সুতরাং বীমা ব্যবসার সিংহভাগই জীবন বীমা কোম্পানির দখলে।

তিনি বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান সব থেকে কম বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব থেকে বেশি বেড়েছে। ২০০৯ সালে দেশের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল ১ শতাংশের বেশি। বর্তমানে তা কমে ০.৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আগরওয়াল বলেন, আমরা প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার ওপরে দাবি পরিশোধের পরও নিয়মিত আমাদের লাইফ ফান্ড বাড়ছে। কারণ, ডেল্টা লাইফ আইডিআরএ সব নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা করে।

আইডিআরএর সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য রয়েছে। তাতে দেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর অনিষ্পন্ন দাবিতে ৫৭২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আটকে আছে। ২ লাখ ৭১ হাজার ২৪০টি পলিসির দাবি অনিষ্পন্ন রয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু দাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি, সারেন্ডার বা মেয়াদ পুর্তির আগে বীমা ভেঙে ফেলা, সার্ভাইবেল বেনিফিট এবং গোষ্ঠী ও স্বাস্থ্য বীমার দাবি রয়েছে। এছাড়া সেপ্টেম্বর শেষে ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৯৬৩টি পলিসি তামাদি অবস্থায় রয়েছে। এসব পলিসির গ্রাহকদের মধ্যে যাদের নিয়ম অনুযায়ী অর্থ ফেরত পাওয়ার কথা, তাদের অনেকেই অর্থ পাচ্ছেন না।

বীমা শিল্পের বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট এন্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী মনে করেন, 'বীমা খাতের প্রধান সমস্যা ভাবমূর্তি সংকট। অনেকেই এখনও এ খাতকে আস্থায় নিতে পারেনি।'

জীবন বীমা করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সোহরাব উদ্দিন একচুয়ারি বলেন, 'অনেকে মনে করেন বীমা কোম্পানিতে টাকা রাখলে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এই অনাস্থা দূর করতে হবে।' 

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, যে দেশের বীমা খাত যত শক্তিশালী, সে দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। সমস্যা দূর করে এ খাতকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আস্থা সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এরফলে সামগ্রিকভাবে বীমা শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, বিষয়টি উপলব্ধি করে বীমা কোম্পানি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।সরকারকে কঠোর হতে হবে। বিশেষ করে কোনোভাবেই অপরাধীদের ছাড় দেয়া যাবে না।

সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করছে, বীমা খাত বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অনেক অগ্রসর হবে। এতে জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান বাড়বে।

এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে আইডিআরএ এক কর্মকর্তা বলেন, ইতিমধ্যে আমরা অভিযুক্ত প্রতিটি কোম্পানির সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে কঠোর বার্তা দিয়েছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা না দিলে বাধ্য হয়েই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমরাও আশা করি কর্তৃপক্ষ বীমা খাতে বিদ্যমান আস্থার সংকট কাটাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, যাতে গুটিকয়েক কোম্পানির কারণে গোটা বীমা শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত না হয়।